সব
তিস্তায় পানি বেড়ে তিন জেলা প্লাবিত
উজানের ঢল আর ভারি বৃষ্টিপাতে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তিন জেলার সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ৬টায় দিকে ডালিয়া পয়েন্টে এ নদীর পানি ১৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদৌলা।
তিনি বলেন, তিস্তা ব্যারেজ রক্ষার্থে ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
আর আগে সকাল ৬টার দিকে এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পরে দুপুর ১২টা নাগাদ তা কিছুটা কমে বিপৎসীমার ১৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও বেলা ৩টার দিকে ফের বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, “পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে পারে। ফলে পানি আরও বাড়বে পারে। পরে নেমে যাবে।”
সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, ছয়আনী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, বাঘের চর, ফকিরপাড়া ইউপির রমনীগঞ্জ, সিঙ্গামারি ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না ইউপির পাটিকাপাড়া, হলদিবাড়ী, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৌলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, কালমাটি, পলাশী ও সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কুলাঘাট, ফলীমারীর চর, মোগলহাট, বড়বাড়ি, রাজপুর, গোকু-া ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
এতে মানুষ পানিবন্দি হওয়ার পাশাপাশি ডুবেছে বাড়িঘর, চলাচলের রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।
আরও পড়ুন :যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট বার্তা, শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন
গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়ে পানিবন্দি মানুষ উঁচু স্থানে অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। অনেকেই উঁচু স্থানে চুলা জ্বালিয়ে রান্নার কাজ সারছেন। নলকূপ, টয়লেটে পানি উঠায় বিশুদ্ধ পানি সংকট ও স্যানিটেশন সমস্যায় পড়ছেন নি¤œাঞ্চলের মানুষ।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোছার গোবর্ধন এলাকার জামাল মিয়া বলেন, “সকাল থেকেই পানি বাড়ছে, বাড়িঘর ডুবে যাচ্ছে। অনেকটা বিপদে পড়ে আছি।”
একই গ্রামের মহুবর রহমান বলেন, “সকাল থেকেই পানি হাঁটু সমান, তাই খাটের উপর চুলা তুলে রান্নাবান্না কাজ করতে হচ্ছে। গরু-ছাগল বাঁধে নিয়ে গিয়ে রাখছি। কোনো রকমে খাটের উপরে উঠে থাকতে হচ্ছে।”
আদিতমারী উপজেলার স্পারবাঁধ এলাকার শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, “পানির উপর চলাচল করছি। তার উপর আবার নদীর পানি বাড়তেই আছে, তাতে মনে হচ্ছে ঘরসহ সব ডুবে যাবে।”
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ বলেন, “আমরা সার্বক্ষণিক বন্যার খোঁজ রাখছি। জেলায় দুর্যোগকালীন ৪৫০ মেট্রিক টন চাল ও সাত লাখ টাকা বরাদ্দ আছে।”
তিনি আরও বলেন, “এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) মাধ্যমে ১১০ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে।”
এ ছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
নীলফামারী: ডিমলা উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ১৫টি চরগ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত দুই সহস্রাধিক পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারের মধ্যে অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাচ্ছে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান বলেন, “বুধবার রাত থেকে নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। এতে করে বৃহস্পতিবার সকালে আমার ইউনিয়নের পূর্বছাতনাই এবং ঝাড়সিংহেশ্ব গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবারের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করে।
তিনি আরও বলেন, “দুপুর ১২টায় পানি কিছুটা কমলে স্বস্তি ফিরে পরিবারগুলোর মধ্যে। তবে বিকাল ৩টায় ফের নদীর পানি বাড়াতে থাকায় অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাচ্ছে।”
টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ময়নুল হক বলেন, “তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে ইউনিয়নের টাবুর চর, পাগলার চর, টেপাখড়িবাড়িসহ আরও কয়েকটি চরগ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় অনেকে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।”
খালিশাচাপানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সহিদুজ্জামান সরকার বলেন, “পানি বৃদ্ধির ফলে ইউনিয়নের ছোটখাতা ও বাইশপুকুর গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুপুরে পানি কিছুটা কমলেও বিকালে ফের বাড়তে শুরু করেছে নদীর পানি। এতে আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়েছে নদীপাড়ের মানুষের মাঝে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদৌলা বলেন, “রাতে আরও কিছুটা পানি বাড়বে। আগামীকাল সকালে পানি কমার পূর্বাভাস রয়েছে।
“তিস্তা ব্যারাজের সবকটি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। সার্বিকভাবে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। পানি বাড়লেও কোনো বাঁধ কিংবা অবকাঠামো কোথাও কোনো ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।”
যে সব দুর্বল পয়েন্টে ছিল তা বর্ষার আগ থেকেই সংস্কার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, “আমরা সর্বক্ষণিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।
“এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ পরিবার পানিবন্দি হয়েছে সেই তথ্য হাতে আসেনি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদেরকে পানিবন্দি মানুষের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করব। প্রয়োজন হলেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেব।”
রংপুর: তিস্তার পানি বাড়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার চরাঞ্চল ও নি¤œাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। ফলে স্থানীয় লোকজন গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিসহ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছেন। তলিয়ে গেছে রোপণ করা ধানের বীজতলা।
বৃহস্পতিবার বিকালে সরেজমিন দেখা গেছে, তিস্তার পানি বাড়ায় গঙ্গাচড়া উপজেলার চর নোহালী, ছালাপাক আলালের চর, মটুকপুর, চিলাখাল, বিনবিনা ইশোরকোল, খলাইয়ের চর, কাশিয়াবাড়ীর চর, ইচলি, চল্লিশসাল চরে বসবাসকারী পরিবারগুলো পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
চিলাখাল এলাকার রফিকুল ইসলাম বলেন, “হামারগুলার বাপদাদার ভিটামাটি সবকিছুই নদীর পারত, এই জন্যেতে কপালে না আঁটি পরি আছি এই নদীর পারত। এত কিছু নদী শাসন নিয়ে, মিছিল মিটিং করল, যদি নদীটা শাসন করি দেয় সরকার; তা কই নদী শাসনের কিছুই দেখি চোল না।”
বিনবিনা ইশোরকোল গ্রামের বাসিন্দা সাদেকুল ইসলাম বলেন, “কালকেও পানি একটু কম ছিল। শুক্রবার সকাল থাকি পানির চাপটা একটু বেশি বাড়ছে। এ জন্য চরের মধ্যে থাকা পরিবারগুলো গরু, ছাগল নিয়া নৌকাত করি উঁচু জায়গাত আসিবার লাগতেছে।”
সূত্র : এনএনবি
Time news FB Link
মন্তব্য