
মোস্তফা কামাল : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা ক্ষমতাহীন বিএনপি কোনোটিই আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম নয়। ঘর-দোর ছেড়ে চিল্লায় চলে যাওয়ার দল তাবলিগও নয়। দেশপ্রেম-দেশসেবাসহ তাত্ত্বিক নানা কথা বলা হলেও ক্ষমতাই তাদের কাছে মুখ্য। ক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছু গুরুত্বহীন তাদের কাছে। ক্ষমতামুখী দলের ধর্মই হচ্ছে মসনদে থাকলে একমাত্র চিন্তা টিকে থাকা এবং তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। আর ক্ষমতাহীন থাকলে ক্ষমতাসীনকে হটিয়ে গদিনশীল হওয়া। সেক্ষেত্রে টানা সোয়া এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি কিছুদিন আগে আর রাখঢাক না রেখে এক দফার কথা জানিয়ে দিয়েছে। আর সেই দফাটি হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের হটানো। যার আরেক অর্থ নিজে ক্ষমতাসীন হওয়া।
এক ইস্তফা না দিয়ে বিএনপি এখন চলে গেছে একত্রিশে। এর আগে ছিল দশে। আন্দোলনের দশ দফার মাঝে এক পর্যায়ে যোগ করেছে রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা। আর দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ঘোষিত ১৯ দফা তো রয়েছেই। যোগফলে আটাশির সমাহারে এখন বিএনপির পথচলা। জুলাইর ১২ তারিখের প্রতি ছিল অনেকেরই টান টান আগ্রহ। বিএনপি কর্মীদের আগ্রহের পারদ থাকে একটু বেশি চাঙ্গা। তা এখন অনেকটা ধপাস করে নিভে গেছে পরদিনই ৩১ দফার মারে। এর আগে গত বছর ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে নির্ধারিত জনসভা হতে দেয়নি সরকার। তা চলে যায় গোপীবাগের মাঠে। এবার বিএনপির জনসভা ছিল দেখার মতো। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ছাড়া এমন বৃহৎ জনসভা দলটির বিশাল অর্জন।
স্বাভাবিকভাবেই বিএনপির মঞ্চে সেদিন বক্তার অভাব ছিল না। তবে বক্তব্য ছিল একেবারে গৎবাঁধা-নির্জীব। মহাসচিবের কণ্ঠে এক দফার ঘোষণার মাঝে কিছু উপদফা আর পদযাত্রা ঘোষণা। যা বিএনপি এরই মধ্যে কয়েক ডজনবার করেছে। ১২ জুলাই এক দফা ঘোষণার পর ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ৩১ দফা ঘোষণা নিয়ে কর্মীরা প্রশ্নবিদ্ধ। এই ৩১ দফা কাদের উদ্দেশ্যে? এর উদ্দীষ্ট দর্শক-শ্রোতা কারা? দল, দেশের জনগণ না বিদেশিরা? তাও রহস্যঘেরা। এর আগে বিএনপির আন্দোলনের ১০ দফা এবং রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফার কয়েকটি ছিল স্পষ্ট। নির্বাচনে অংশগ্রহণের দর কষাকষির কিছু রফাও ছিল সেখানে। এখন ৩১ দফায় এক দফা হালকা-ফ্যাকাসে হয়ে পড়েছে। এরপরও এসব দফার আড়ালে রয়েছে অনুচ্চারিত অনেক বার্তা।
প্রতিনিয়ত যেখানে ঘটনাপ্রবাহ পরিবর্তিত হয়, সেখানে দফার হেরফের ঘটা অনেকটা স্বাভাবিক। এক ধরনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক আবহাওয়ার মাঝেই ১২ জুলাই ঢাকায় বিএনপি-আওয়ামী লীগের সমাবেশ। কিছুটা আকস্মিকও বটে। তাদের সমাবেশ যে প্রতিযোগিতামূলক হবে তা ধারণার বাইরে ছিল না। দুটি বিদেশি প্রতিনিধি দলের বিদ্যমান পরিস্থিতি কেন্দ্রিক উপলক্ষে দেশে অবস্থানই সমাবেশের মূল কারণ। ইওনাউ দিমিত্রার নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট ইইউর প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকা আসে ৮ জুলাই। অন্য দলটি মার্কিন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়ার নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল। যে দলে আরো ছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার এশিয়া দপ্তরের উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলী কৌর।
আরও পড়ুন : বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা কি অসম্ভব?
সচরাচর ঢাকায় জনসভা নির্ধারণে বড় দলগুলো শনিবারকে বিবেচনায় নেয়। কিন্তু এবার অনিবার্যভাবে বুধবার কর্মদিবসেই করতে হয়। সরকারও এবার বিএনপির দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় বাধা দেয়নি। আর আওয়ামী লীগ করেছে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে। সমাবেশের কারণে এদিন জনভোগান্তি কারো কাছে বিষয় হয়নি। উভয় দলই যার যার সমাবেশ থেকে দিয়েছে এক দফার ঘোষণা। কেউ সরকার পতনের, কেউ এ সরকারের অধীনেই নির্বাচনের। বিএনপির ৩১ দফার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠার কথা। সমাবেশের পরদিন চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব দফা ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা ঘোষণায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, সেই রাষ্ট্রের মালিকানা আজ তাদের হাতে নেই। বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। এই রাষ্ট্র মেরামত ও পুনর্গঠন করতে তাই ৩১ দফার অবতারণা। দফাওয়ারি এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেখানে রয়েছে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা। এ জন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছার অভিপ্রায় জানানো হয়েছে।
‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, পরপর দুই টার্মের বেশি কারো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করা, বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তনের মতো ফর্মুলার কথা তাদের ২৭ দফায়ও ছিল। ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা, নারীর ক্ষমতায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেয়ার কথাও ছিল। এর আগে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে দেয়া হয় বিএনপির বহুল আলোচিত ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত’-এর ২৭ দফা রূপরেখা। তখন জানানো হয়েছিল রূপরেখাটির ভিত্তি রচনা হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘১৯ দফা’ এবং বেগম খালেদা জিয়া ঘোষিত বিএনপির ‘ভিশন-২০৩০’-এর আলোকে। সাধু ভাষায় দেয়া রূপরেখায় বলা হয়েছিল : একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করিয়া সব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ পর্যালোচনা করিয়া এই সব রহিত/সংশোধন করা হইবে এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা হইবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করিয়া জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হইবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠার রূপরেখা রাজনীতিতে ব্যাপক আলোচনা পায়।
‘নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনয়ন করা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয়ের কথা সেখানেও ছিল। পরপর দুই টার্মের বেশি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করার কথাও ছিল। এখনকার একত্রিশ সেই সাতাশেরই পুনরুল্লেখ। যার কিছু কিছু ছিল এর আগে, ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিভাগীয় সমাবেশ থেকে দেয়া ১০ দফার মাঝেও। নানা দফার কোনো রফা না করে কিছুদিন আগে জনসভা থেকে এক দফা এক দাবি সরকারের পদত্যাগ বা সরকার হটানোতে চলে আসে বিএনপি। এক দফা থেকে এখন আবার ব্যাক গিয়ারে একত্রিশে ফিরে যাওয়ার কিনারা হাতিয়ে পাচ্ছে না দলটির কর্মীরা। পরিস্থিতিটা তাদের জন্য অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। বিশেষ করে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আওয়াজ বেশ দুর্বোধ্য। বিভিন্ন কর্নার থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে- সরকার সংবিধানের দোহাই দিলেও বিচারপতি খায়রুল হকের রায়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার সুযোগ রয়েছে। খায়রুল হকের সংক্ষিপ্ত রায়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে। এ নিয়ে সভা-সেমিনার ডাকা হচ্ছে নিয়মিত। একদিকে বলা হচ্ছে, রায়টির আইনগত ভিত্তি নেই। বিচারপতি অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর রায় লেখাও আইনসিদ্ধ নয়। আবার বলা হচ্ছে, রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশে তত্ত্বাবধায়কের স্বীকৃতি আছে। ভূ-রাজনীতি ও কূটনৈতিক উত্তেজনার পারদে অঘটনের ঘনঘটার একটি আশাবাদ থেকেই মূলত দফার চক্করে ছুটছে বিএনপি। আগামী নির্বাচন অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করতে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতার জেরে বেনিফিসিয়ারি হওয়ার আশাবাদ প্রকারান্তরে বিএনপির নিজেদের ফাঁদে আটকে যাওয়ার শঙ্কাকে উসকে দিচ্ছে কি-না, এ প্রশ্নও ঘুরছে।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
mostofa71@gmail.com